রোজার মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য
- আপলোড সময় : ০২-০৩-২০২৫ ০৬:০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০২-০৩-২০২৫ ০৬:০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন

মো. আবদুর রহমান
রোজা ফার্সি শব্দ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে রোজা শব্দই ব্যবহৃত হয়। আরবিতে বলা হয় ‘সিয়াম’। ‘সিয়াম’-এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সঙ্গে পানাহার ও ইন্দ্রিয়তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম বা রোজা। ইসলামি বর্ষপঞ্জির নবম মাস রমজান। এটি এমন একটি মাস যার সঙ্গে বিশ্ব মুসলিমের রয়েছে আত্মার সম্পর্ক।
রমজান শব্দটি আরবি ‘রমজ’ থেকে এসেছে। এর অর্থ পুড়িয়ে ফেলা। এক মাসব্যাপী এই রোজা মানুষের মধ্যকার সকল পাপ ও অকল্যাণকে পুড়িয়ে ফেলে তাকে আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়, সেজন্য এর নাম সিয়াম বা সংযম। এ মাসে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, রোগী, মুসাফির, পাগল, হায়েজ-নেফাস সম্পন্ননারী এবং শরিয়তের পরিভাষায় অক্ষম ছাড়া প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর রোজা পালন করা ফরজ। আমাদের পূর্ববর্তী মানুষদের ওপরও রোজা ফরজ ছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা পালন ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা ১৮৩)
তাকওয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ভয় করা, বিরত থাকা, বর্জন করা, আত্মশুদ্ধি, নিজেকে কোনো অনিষ্ট থেকে সম্ভাব্য সব উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা। পরিভাষায় সব ধরনের অন্যায় ও অনাচার বর্জন করে কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপনের মাধ্যমে আল্লাহকে প্রতিনিয়ত ভয় করে চলাকে তাকওয়া বলে। সুতরাং তাকওয়ার অর্থ হলো আল্লাহভীতি তথা সব কাজে আল্লাহকে ভয় করা।
মানব জীবনে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাসেই নাজিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। তাই তো এ মাসের এত মর্যাদা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, “রমজান মাস হলো সেই মাস, যে মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানুষের পথপ্রদর্শক, সত্য পথের উজ্জ্বল নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পায়, তারা যেন রোজা রাখে, কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে সে যেন অন্য সময়ে সেই (রোজার) সংখ্যাগুলো পূরণ করে।” (সুরা বাকারা ১৮৫) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো প্রয়োজন ও রোগ ছাড়া রমজান মাসের একটি রোজা ভেঙে ফেলে, তার সারা জীবনের রোজা দ্বারাও এর ক্ষতিপূরণ হবে না। যদিও সে সারা জীবন রোজা পালন করে।” (সুনানে তিরমিজি) কারণ রমজান মাসে রহমতের যে প্লাবনধারা প্রবাহিত হয়, বছরের অন্য কোনো সময় তা কল্পনাও করা যায় না।
হাদিস শরিফে রমজান মাসকে তিনটি দশকে ভাগ করা হয়েছে। এর প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের এবং তৃতীয় দশক নাজাতের। এই তিনটি দশকে প্রত্যেকটির গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম। ‘নাজাত’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ মুক্তি। এ মুক্তি অকল্যাণ থেকে মুক্তি, এ মুক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি। আর এ মুক্তির জন্যই ইতিকাফের সাধনা।
নাজাতের দশকে বিজোড় রাতগুলোর একটিকে বলা হয় লাইলাতুল কদর বা কদর রজনি। ফারসিতে হলো শবে কদর। এর অর্থ ভাগ্য নির্ধারণী রজনি। একটি বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ রাত হলো শবে কদর। এ রাতেই মহাগ্রন্থ আল-কোরআন নাজিল হয়েছে। এ রাত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, “আমি এটি শবে কদরে নাজিল করেছি। আপনি কি জানেন, শবে কদর কী? শবে কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” (সুরা কদর ১-৩) এই কদরের এক রাতের ইবাদতে এক হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও অনেক বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। এক হাজার মাস তিরাশি বছরের কিছু বেশি সময় হয়। আল্লাহতায়ালা এ রাতে বান্দার তওবা কবুল করেন, বান্দাদের ব্যাপক হারে ক্ষমা করেন এবং তাদের মাঝে অফুরান কল্যাণ দান করেন।
শবে কদরে ফেরেশতারা দুনিয়ায় আসেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, “শবে কদরে হজরত জিবরাইল (আ.) একদল ফেরেশতাসহ পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং আল্লাহর প্রত্যেক বান্দার জন্য রহমতের দোয়া করেন যারা দাঁড়িয়ে বা বসে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকেন।” (মিশকাত) অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, “এতে (রমজান) এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে।” (মুসনাদে আহমাদ)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি বলে দিন, যদি আমি জানতে পারি যে, শবে কদর কোন রাতে হবে, তাহলে তাতে আমি কি দোয়া বলব? রাসুল (সা.) বললেন, তুমি বলবে, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি।” অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। (তিরমিজি)
পবিত্র রমজানের রোজা সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে দেহ ও মনকে রক্ষা করে। সিয়াম সাধনা মানুষের মনের কলুষতাকে পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়ে মনকে নির্মল ও পবিত্র করে তুলে। পাপরাশিকে সম্পূর্ণরূপে দগ্ধ করে মানুষকে করে তুলে পুণ্যবান। সাধারণ মানুষকে আল্লাহতায়ালার করুণা ও ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য করে তুলে। আর এটাই হচ্ছে রোজার মূলতত্ত্ব। হাদিসে উল্লেখ হয়েছে, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা ইমান ও ইখলাসের সঙ্গে পালন করে তার অতীতের সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারি) আর যে ব্যক্তি রমজানে রাত জাগরণ করে ইবাদতে মশগুল থাকে তারও পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি শবে কদরে ইমান ও একিনের সঙ্গে ইবাদত করে তারও সব গুনাহ আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দেন। (সহিহ বুখারি) রোজা পালনের দ্বারা মানুষের ইন্দ্রিয়লব্ধ পাপরাশি জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় এবং দেহ কাঠামো পাপমুক্ত ও পবিত্র হয়।
বস্তুত রোজা হলো কুপ্রবৃত্তিকে আয়ত্তে আনার হাতিয়ার। রোজা মনকে পরিচ্ছন্ন ও উজ্জ্বল করে। রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। শত্রুর আক্রমণ থেকে ঢাল যেরূপ পরিত্রাণ দেয়, রোজা সেরূপ রোজাদারকে শয়তানের ওয়াসওয়াসা, অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে রক্ষা ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তিলাভের জন্য ঢালস্বরূপ। অথচ এ ঢালকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য মিথ্যা ও পরনিন্দা থেকে পরহেজ থাকতে হবে।
কেয়ামতের দিন রোজাদারের জন্য রোজা সুপারিশ করবে। রোজাদারের জান্নাতে প্রবেশের জন্য ‘রাইয়ান’ নামক একটি বিশেষ দরজা আছে, সেই দরজা দিয়ে রোজাদাররা প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করবে এবং তারা কখনো তৃষ্ণার কষ্ট পাবে না। অন্যরাও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চাইবে। কিন্তু রোজাদার ছাড়া অন্য কাউকে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ